, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ , ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ


হাওর এলাকার কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী

  • আপলোড সময় : ০৫-১০-২০২৩ ০২:২৩:৩০ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০৫-১০-২০২৩ ০২:২৩:৩০ অপরাহ্ন
হাওর এলাকার কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী
মোঃ আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নীলাভূমি খাল-বিল-নদী-নালায় ঘেরা সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এই জেলা।এলাকার প্রায় শতকরা ৯০জন লোকই মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। তোলার বিশেষত বোরো ফসল ঘরে তুলতে না পারলে বাঁচা-মরার প্রশ্ন দেখা দেয়। ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও বরাক অঞ্চলের অতি বৃষ্টির কারণে নেমে আসা ঢলের পানির কারনে একদিকে ভাটি এলাকায় সৃষ্টি হয় আগাম বন্যা, অপরদিকে পাহাড়ি ঢলের সাথে ভেসে আসা পলিমাটি ও বালি, পাথরের কারনে নাব্যতা হারাচ্ছে এলাকার নদ-নদীগুলো। প্রতি বছর পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় বোরো ফসল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই অত্র এলাকার বোরো চাষিরা জমিতে ফসল ফলায়।

অপরদিকে বোরো ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছর পাউবো কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারী প্রথায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বাধ নির্মাণের নামে লুটপাট করে আসছিলো দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু ২০১৭ সালে হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ব্যাপক ফসলহানির পর পাউবো কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ এনে আন্দোলনে নামে ”সুনামগঞ্জ হাওর বাচাও আন্দোলন” এর নেতাকর্মীসহ কৃষক জনতা। সে সময় প্রকৃত কৃষকদের দিয়ে পিআইসি গঠনের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তারা। এলাকার আপামর সর্বসাধারনের দাবীর প্রেক্ষিতে পিআইসির মাধ্যমে বাধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। গণ-শুনানির মাধ্যমে পিআইস গঠন করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে দলীয় নেতৃবৃন্দ ও উপজেলা প্রশাসনের স্বদিচ্ছার অভাবে তা আর হয়ে উঠেনি। গত বছর পর্যন্ত প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে শতশত পিআইসি টিম গঠন করে বাঁধের কাজ সম্পন্ন করা হয়। তবে পিআইসিগুলো ঠিকাদারদের চেয়ে ভালো মানের কাজ করেছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যেখানে শতশত কোটি টাকার কাজ মাত্র কয়েকজন ঠিকাদার মিলে করত, বর্তমানে সেই কাজ করছে শতশত পিআইসি টিম। এ বছর কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হওয়ার কারণে ফসল তেমন একটা নষ্ট হয়নি। কাজেই অনেক স্থানে পুরনো বাঁধগুলি এখনও টিকে আছে। এইসব বাঁধগুলিকে কিভাবে আরো টেকসই করা যায় সে ব্যাপারে এখন থেকেই পাউবো কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তবে মূল সমস্যা দেখা দেয় যখন পাউবো কর্মকর্তারা সরেজমিনে হাওরে না গিয়ে অফিসে বসে প্রকল্প তৈরি করেন। পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে বসে পরিকল্পনা তৈরি না করে সরেজমিন পরিদর্শন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করার দাবী জানান অত্র এলাকার কৃষকরা।

হাওর অঞ্চলগুলোকে অকাল বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য ফসল রক্ষা বাঁধের পাশাপাশি নদী খননের মাধ্যমে পানি ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। হাওরের ইজারাদারদের যে সকল শর্ত সাপেক্ষে ইজারা দেওয়া হয় সেগুলো হলো, হাওরের মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য খনন করা, হিজল করচ গাছ লাগানোসহ হাওরের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভূমিকা রাখা। কিন্তু ইজারাদাররা সেই শর্তের তোয়াক্কা না করেই উল্টো হাওরের হিজল-করচ গাছ কেটে সেগুলোকে তাদের মাছ আটকানোর কাটা হিসেবে ব্যবহার করেন। আবার শুকনো মৌসুমে  জলমহাল শুকিয়ে অবৈধ জাল দিয়ে পোনা মাছটিও ধরে বিক্রি করেন। তাদের এই আগ্রাসী লোভের কারণে একদিকে যেমন হাওড়গুলোর পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে অপরদিকে অনেক প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্ত প্রায়।

আর কিছুদিন পরেই শুরু হবে বোরো ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়া, বেশিদিন বাকী নেই কৃষকদের বোরো ফসলের কাজে হাত দেবার। কাজেই পাউবো কর্তৃপক্ষকে যথাসময়ে উদ্যোগ নিয়ে এখনই প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী। প্রকল্পের কাজ দেরিতে শুরু করলে শেষ মুহূর্তে বোরো চাষিদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। সময়মত কাজ শেষ না হলে অকাল বন্যায় ফসল তলিয়ে যাবার আশঙ্কা থেকে যায়।
সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের কৃষকরা বোরো ধান ফলিয়ে দেশবাসীর জন্য খাদ্যে যে বিরাট অবদান রাখছে, বিনিময়ে বোরো চাষিদের দেশবাসী কতটুকু যতœ নিচ্ছে ? বাংলাদেশ গরীব দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের দেশ দিন দিন অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু মূলত দেশে দিন দিন মানুষ কর্মহীন হচ্ছে। নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ”যার আছে তাকে আরো দাও, আর যার কিছু নেই তার কাছে যা আছে তাও ছিনিয়ে নাও” নীতিতে এগুচ্ছে দেশ। অথচ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল প্রত্যেক মানুষের ঘরে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়ার উপরই নির্ভর করে সেই দেশের উন্নতি।

হাওর অঞ্চলের বোরো চাষিরা দেশবাসীকে দিতে জানে, ভোগ করার অধিকার তাদের নেই। এই হাওর অঞ্চলের ৭০% কৃষকই বর্গাচাষী। তারা পরের জমিতে চাষ করে। কৃষি ঋণের সুবিধা তারা পায় না। যে বছর বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হয় সে বছর সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় তারা। এর ঘাটতি পূরণ করা শতকরা ৫০ ভাগ কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয় না। কাজেই এই সব কৃষকদের বেঁচে থাকার জন্য চাষাবাদে টিকে থাকার জন্য সহজ শর্তে দালালীব্যতিত কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কৃষকদের বিনামূল্যে/ভুর্তকি মূল্যে বীজ, সার এবং অন্যান্য উপকরণসহ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো ও অন্যান্য প্রণোদনা দেওয়া এখন সময়ের দাবী।

হাওর এলাকার বোরো ধান তোলার সাথে সাথেই কৃষকরা ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্য কাজের জন্য ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার ঘোষণা দেওয়া হলেও সরকারী অফিসারদের সাথে কিছু দালালদের কমিশন বাণিজ্যের চুক্তির কারনে মাঠ পর্যায়ে তার সুফল পায়না কৃষকরা। আর তাদেরকে ডিঙ্গিয়ে সরাসরি কোন কৃষক গোদামে ধান দিতে গেলেই খাদ্য গোদামে ধান রাখার জন্য উপযুক্ততা যাচাই এর নামে হয়রানিসহ শুরু হয় অফিসিয়াল জটিলতা। কাজেই খাদ্য গোদামে ধান বিক্রি করার ইচ্ছা থাকলেও সিস্টেম জটিলতার কারনে তা আর সম্ভব হয় না।

বোরো চাষকালীন সময় ছাড়া হাওর এলাকার কৃষকদের আর কোনো কাজ থাকেনা। এই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য তাদের নারী-পুরুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে আয়ের উৎস তৈরি করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। সরকারীভাবে এ পর্যন্ত অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এর কোন বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়না।

হাওর এলাকার গ্রামগুলির অবস্থান দ্বীপের মত। বর্ষায় যখন ঢেউ উঠে তখন বাড়ি ভাঙ্গনের শুরু হয়। এর জন্য প্রতি বছর ফসল তুলার পর বাড়ি রক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় কৃষকদের। এমতাবস্থায় বছর বছর বাড়ি রক্ষার ব্যয় থেকে বাঁচাতে হলে সরকারিভাবে প্রতিটি গ্রামের পাশে প্রটেকশন ওয়াল তৈরি করে দেওয়া প্রয়োজন।
 
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতি বছর লাখো পর্যটকরা ভিড় জমান এখানে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের বেধে দেওয়া কোন নিয়মনীতি না মানায় পর্যটকরা হাওরে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষণে মেতে উঠছেন। এ দিকে দৃষ্টি না দিলে ভবিষ্যতে এ হাওরটিতে মাছ উৎপাদন পিছিয়ে পড়বে। এর জন্য কিছু লোক নিয়োগ করে পর্যটকদেরকে নিয়ম নীতিগুলো কঠোরভাবে মানতে বাধ্য করতে হবে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এই এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।এতে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া অতিথি পাখির  নিরাপত্তা প্রদান, পোনামাছ নিধনসহ গাছ লাগানোর উপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কাজেই হাওর অঞ্চলের এসব সমস্যা দূর করতে হলে একটি বৃহৎ পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। আর হাওর এলাকার মানুষের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের জন্য ব্যক্তি উন্নয়নমুখী নীতি পরিহার করে প্রকৃতপক্ষে দেশের উন্নয়নমুখী নীতি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী।
সর্বশেষ সংবাদ